১৫ ডিসেম্বর নির্বাচনী সংঘর্ষে আহত হন বিএনপির মাহবুব উদ্দিন
এরপর বিএনপির নির্বাচনী প্রচার বন্ধ
মাঠে আওয়ামী লীগের এইচ এম ইব্রাহিম
নোয়াখালীতে গতকাল বুধবার সারা দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। কনকনে শীতের এমন দিনে জমজমাট থাকে সোনাইমুড়ী বাজারের মজিবুল হকের চায়ের দোকান। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই মন্দা যাচ্ছে ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের। লোকজন আগের মতো আসছেন না, জমছে না আড্ডাও।
আফসোস করে মজিবুল হক বলছিলেন, নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিক্রি জমে উঠবে বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা–কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে বাজারে মানুষ আসাই কমিয়ে দিয়েছেন। আগে যেখানে শুধু চা বিক্রি করেই তাঁর দেড়-দুই হাজার টাকা আয় হতো, সেখানে এখন তা পাঁচ শ ছাড়াতেই কষ্ট হয়।
মজিবুল হকের চায়ের দোকানের মতোই পুরো নির্বাচনী এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহিম নির্বাচনী প্রচারণা চালালেও বিএনপির প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন ঢাকায় অবস্থান করছেন। ১৫ ডিসেম্বরের নির্বাচনী সংঘর্ষে পুলিশের ছোড়া গুলির স্প্লিন্টারে তিনি আহত হন। এরপর থেকে এই এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ রেখেছে দলটি।
বিএনপির নেতা–কর্মীদের অভিযোগ, দলীয় নেতা–কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের হামলা তাদের যতটা না ভাবাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে পুলিশের ভূমিকা। সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, এমন নেতা–কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ হানা দিচ্ছে। যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদকের মামলাও।
সোনাইমুড়ী ও চাটখিলের বাসিন্দারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে হামলা, এমন পরিস্থিতি তাঁদের এলাকায় আগে ছিল না। নির্বাচন এলেই একধরনের উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। সোনাইমুড়ীর নদনা এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে হামলা–মামলার বিষয়টি এবারই তাঁরা প্রথম দেখছেন।
সোনাইমুড়ী উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন এবং চাটখিল উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নোয়াখালী–১ আসন বিএনপি–অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত। নব্বই দশকের পরবর্তী ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে পাঁচটিতেই জয়ী হন বিএনপির প্রার্থী। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এইচ এম ইব্রাহিম।
চাটখিল উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রচারণা চালানো দূরের কথা, তাঁদের নেতা–কর্মীরা রাতে বাড়িতেই থাকতে পারছেন না। ১৫ ডিসেম্বরের সংঘর্ষে প্রার্থী আহত হলেও সোনাইমুড়ী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক এবং পৌর মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি মোতাহের হোসেনসহ ২৫ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকে দুই উপজেলার অন্তত ৩৩ নেতা–কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে বিএনপির নেতা–কর্মীদের অভিযোগের বিষয়ে নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াস শরীফ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং এজাহারভুক্ত আসামি ছাড়া পুলিশ কারও বাড়িতে হানা দিচ্ছে না।
হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ
চাটখিল উপজেলার খিলপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির প্রচার সম্পাদক মনির হোসেনকে গত মঙ্গলবার সকালে বাড়ির পাশের চায়ের দোকানে মারধর করেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। প্রথম আলোকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, চায়ের দোকানে বসে তিনি চা খাচ্ছিলেন। সেখানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামও ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর উপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের ২০-২৫ জন নেতা–কর্মী এসে রড ও লাঠি দিয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটান।
জানতে চাইলে সিরাজুল ইসলাম গতকাল মুঠোফোনে বলেন, মনির দোকানে বসে উল্টাপাল্টা কথা বলায় এলাকার কিছু ছেলেপেলে ক্ষিপ্ত হয়ে তার ওপর হামলা চালিয়েছে।
একই উপজেলার রামনারায়ণপুর ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের বিএনপি সমর্থক ফয়েজ আহমদের বাড়িতে গত শনিবার রাতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর চায়ের দোকানে বিএনপির নেতা–কর্মীরা জড়ো হয়ে আড্ডা দেন বলেই তাঁর বাড়িতে হামলা চালানো হয়।
হাটপুকুরিয়া ইউনিয়নের যুবদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাইদুল ইসলামের মধ্য নারায়ণপুরের গ্রামের বাড়িতে গত সোমবার সন্ধ্যায় হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। সাইদুল ইসলাম বলেন, সেদিন সন্ধ্যায় ৫০-৬০ যুবক নৌকার স্লোগান দিয়ে তাঁর বাড়িতে হামলা চালান।
পুরোনো মামলায় অভিযোগপত্র
২০১৫ সালের ১৪ মার্চ হিজবুত তাওহিদের সমর্থকদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় হিজবুত তাওহিদের দুজন নিহত হলে পুলিশ বাদী হয়ে তখন সোনাইমুড়ী উপজেলা জামায়াতের আমির ও ৩ নম্বর চাষির হাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হানিফকে একমাত্র আসামি করে মামলা করে। ঘটনার প্রায় তিন বছর পর গত ৩০ নভেম্বর ৬০৯ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এঁদের অধিকাংশই বিএনপির নেতা–কর্মী।
মামলার আইনজীবী ও জেলা বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ৬০৯ জনের মধ্যে ৪০০ জনের বেশি তাঁদের নেতা–কর্মী। চাটখিল ও সোনাইমুড়ীর নির্বাচনী এলাকার ১২৯টি নির্বাচনী সেন্টারের আওতাধীন লোকজনই এতে রয়েছেন। তাঁর দাবি, নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই অভিযোগপত্র দিয়েছে।
যা বললেন দুই প্রার্থী
বিএনপির নেতা–কর্মীরা গতকাল যখন মামলা, হামলা ও ভাঙচুরের কথা বলছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহিম সোনাইমুড়ীর দেওটি ও আমিষাপাড়া ইউনিয়নে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। বিকেলে আমিষাপাড়ার আবিরপাড়া বাজারে তাঁর সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। পরিচয় পেয়ে তাঁর প্রথম কথাই ছিল, ‘আপনারা তো আমাদের বিরুদ্ধে সব সময় লিখেন। কী আর বলব।’ বিএনপির নেতা–কর্মীদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা। তারা নাটক করছে। সেদিন বিএনপির প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন গুলি খেয়েছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস বলেন, বিএনপি যেসব মামলা, হামলা ও ভাঙচুরের কথা বলছে, সেগুলো লিখিতভাবে জানায়নি। তারপরও মৌখিকভাবে যেসব অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তার ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন টেলিফোনে বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে তাঁর দলের নেতা–কর্মীদের হুমকি–ধমকি, বাড়িঘরে হামলা–ভাঙচুর অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ ও অবৈধ অস্ত্রধারীদের ভয়ে লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত। এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সুত্রঃ প্রথম আলো